‘কিভাবে সফল জুটি গড়বেন’


আধুনিক ঘটক

Published On 12-04-2012

‘কিভাবে সফল জুটি গড়বেন’ সেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা প্রশ্নটির বিজ্ঞাননির্ভর উত্তর নিয়ে এসেছে বলে দাবি ইন্টারনেট ডেটিং সাইটগুলোর। কিন্তু তারা কী সত্যি সেটা পারছে?  অন্যরা বাদ সাধবে জেনেও ভালোবাসার সম্পর্কে জড়ায় মানুষ। আর এই অন্যদের মধ্যে মা-বাবা, ধর্ম, বন্ধুসহ আমলাতন্ত্রও রয়েছে। তাদের সবার উদ্দেশ্য কমবেশি একইরকম। তারা মনে করে, জোড় বাঁধা মানুষগুলোর চেয়ে, আগের মানুষটিকে তারা বেশি চিনত-জানত।

তবে, তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে ইন্টারনেটের দুনিয়াতেও পাওয়া যায় ঘটক। পুরনো ঘটকের সঙ্গে তুলনায়, অন্তত দু’ভাবে এই ঘটকরা আলাদা। প্রথমত, তাদের প্রথম উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন করা। দ্বিতীয়ত, যারা একক থেকে দ্বৈত হতে চান তাদের মনে ঘটকের নানা আচরণে বিরক্তি আসলেও সেটাকে অগ্রাহ্য করে তাদের অপেক্ষা করতে হয়। ইন্টারনেট ডেটিং সাইটগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছে সাধারণত দুটো প্রতিশ্রুতি নিয়ে উপস্থিত হয়। একটি হলো, তারা আসলে ঘটক বলতে যা বোঝায় তা নয়, এমনকি পথে-ঘাটে ছড়িয়ে থাকা কোনো সুযোগ-সন্ধানীও নয় তারা। সম্ভাব্য জীবন সঙ্গীনিকে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে একজনকে বাছাইয়ের সুযোগ থাকছে এখানে। এছাড়াও, সমমনা একজনকে খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং ‘চিরসুখী’ হওয়ার প্রত্যয়ে ঘর বাঁধার বিষয়টি যে তারা বাড়িয়ে তোলে তাও বিজ্ঞানসম্মত।

সঙ্গীনিকে বাছাই করার ক্ষেত্রে অনেক থেকে একজনকে পছন্দ থাকার সুযোগটি প্রশ্নাতীত। কিন্তু এটা কী প্রকৃতার্থেই ভালো কোনো ফল বয়ে আনছে? বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এই অ্যালগরিদম কী আসলেই ক্রিয়াশীল কিংবা বিয়েপূর্ব সম্পর্কের ক্ষেত্রে (অন্তত ভালোবাসার নামে প্রতারণা) কী ভালো কিছু বয়ে আনতে পারছে? এই প্রশ্নগুলো রেখেছেন ইলিনয়ের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনরোগ বিশেষজ্ঞ দলপ্রধান এলি ফিনকেল। ভালোবাসা দিবসের প্রাক্কালে ‘সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স ইন দ্য পাবলিক ইন্টারেস্ট’-এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ১৯৯৫ সালে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য তৈরি ঘটক সাইট ম্যাচ.কম-এর পর্যালোচনা করেই এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ড. ফিনকেল ও সহকর্মীরা বহু কোটি ডলারের এই ঘটক সাইটটি বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, যা আসলে প্রচন্ড সন্দেহ উদ্রেককারী।

পাক্কা জীবনসঙ্গীর নীলনকশা? : এ প্রশ্নের উত্তরে গবেষকদের প্রথম পর্যবেক্ষণে তারা আসলে যেসব উপাত্ত যোগাড় করেছেন, তা যথার্থভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হন। এমনকি, তারা দেখাতে পারেনি এসব ঘটক সাইটের মাধ্যমে ঘরবাঁধা দুজনের অ্যালগরিদম ঠিকমত কাজ করছে কিনা।

অবশ্য, বাণিজ্যিকভাবে এটি যথেষ্ট ঝামেলামুক্ত। জনগণের কাছ থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের বুদ্ধিভিত্তিক সম্পত্তিকে বাণিজ্যিক কারণে গোপন রাখছে। কিন্তু এদের মধ্যে কেন ইন্টারনেট ডেটিং সাইটগুলো নেই, সে বিষয়ের প্রশ্ন তোলার কারণ নেই। এখানে স্বাধীন বিজ্ঞাননির্ভর কোনো প্রমাণ নেই, যার ফলে জানা যাবে, জোড়া বেঁধে ফেলার পর তরুণ-তরুণীরা পুনরায় ওয়েবসাইটগুলোতে ঢু মারছে কিনা। আর এ বিষয়ে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা লিখেছে কোম্পানির ভেতরকার লোক, যারা আসলে কখনোই প্রকাশ করবে না তাদের কর্মীরা কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলো নিয়ে কিভাবে কাজ করছে।

কঠিন কাজ হলেও এটা নির্ণয় করা সম্ভব যে, উপযুক্ত চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের বিচারেই একে অপরের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে কিনা তা খুঁজে দেখার বিষয়টি। কোনো সন্দেহ নেই, তারা সেটা করে। তারা যেটা করে সেটা হচ্ছে, বিষয়ভিত্তিক কিছু প্রশ্ন দিয়ে একটি আবেদনপত্র পূরণ করিয়ে নেওয়া হয়। যা আসলে অনুমাননির্ভর, কিন্তু প্রমাণিত নয়। যদিও এটা ভালো যে, দু’জনের মধ্যে মিল থাকলে তারা সফল দম্পতি হতে পারবেন। আর এই অংশটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই ২০১০ সালে প্রকাশিত নিউইয়র্কের হোবার্ট অ্যান্ড উইলিয়াম স্মিথ কলেজের ড. পোর্শিয়া ডাইরেনফোর্থের একটি নিবন্ধের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ড. ফিনকেল। অন্তত হাজার বিশেক মানুষের কাছে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন এবং তাদের ব্যক্তিত্বকে বোঝার চেষ্টা করেছেন ডেরেনফোর্থ। যেসব দম্পতির চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্বের মিল রয়েছে তাদের অন্যদের তুলনায় সুখী বলে নিজের গবেষণায় উল্লেখ করেন ডেরেনফোর্থ। কিন্তু সেই ব্যবধান যে অনেক বেশি তা কিন্তু নয়। সেই পরিমাণ ছিল মাত্র ০.৫ শতাংশ। ড. ফিনকেল বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দাবি করে, তাদের অ্যালগরিদম একটি সম্পর্ক তৈরি ও তা স্থায়ীকরণের সুযোগ তারা বাড়িয়ে দিতে পারে, তখন আমি খুব একটা সমস্যা দেখি না। কিন্তু আমি তখনই অাঁতকে উঠি যখন প্রতিষ্ঠানগুলো বলতে দেখি, আমরা আপনার জন্য আপনার আত্মার সঙ্গীকে তুলে এনে খুঁজে বের করে দেব।’

নিশ্চিতভাবে, সঙ্গী খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো পছন্দ থেকে বাছাই করে নেওয়ার বিষয়টি জাদুকরি হলেও কিন্তু সেখানে কিছু বিষয় আছে, যা আসলে যতটা সহজ মনে হয়, আদতে ততটা সহজ নয়।

কিছু ডেটিং সাইটের অ্যালগরিদমের অবশ্য উচ্চ-বাচ্য ‘আমরাই সবার সেরাটা জানি’ এধরনের কোনো ভাব থাকে না। বরং তাদের ক্রেতা অর্থাৎ কোনো পুরুষ অথবা নারীকে তাদের পছন্দের নারী কিংবা পুরুষকে পছন্দ করার জন্য, ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত ওই ব্যক্তির তথ্য জানার সুযোগ দেয়। এটা অনেকটা যেন, সঙ্গী নির্বাচন করতে তাদের সুবিধা হয় এমন।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মানুষ আসলে ভাবে তারা সেটাই চায়, যা তাদের অবশ্যই প্রয়োজন। এটা সত্য যে, প্রত্যেক ক্রেতার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে মূলত অনুমান শক্তিই কাজ করে। কিন্তু ইন্টারনেটে বসে একটি বই কিংবা ওয়াশিং মেশিন পছন্দ করেও সেটি সম্পর্কে মনের বদল ঘটলে সেটা যেমন অপরাধের বিষয় নয়, ঠিক তেমনি ইন্টারনেটে বসা পছন্দ করা জীবনসঙ্গী সম্পর্কেও মনের বদল ঘটলে, সেটাও প্রতারণা হবে না। তার ওপর, গবষেণা বলছে, মানুষ আসলে কি চায়, সেই সম্পর্কে মানুষের আসলে অত ভালো ধারণা নেই। ফিনকেলের নিজস্ব একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যখন ইন্টারনেটে বসে ডেটিংয়ের জন্য সঙ্গী বাছাই করে, এবং শুরুতে যেসব আচরণ করে, তা আসলে কখনোই তাদের প্রকৃত চাওয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে না বা সঙ্গতিপূর্ণ হয় না।

এছাড়া, পছন্দের অনেক বেশি সুযোগ থাকাটাও একটা বড় সমস্যা। ক্রেতাদের পছন্দের ওপর তৈরি করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, চকোলেট থেকে শুরু করে কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া পর্যন্ত বিষয়গুলোতে তারা বেশ চিন্তায় পড়ে যায়, কোনটা ছেড়ে কোনটা গ্রহণ করবে। বরং ৩০ থেকে ৪০টি পছন্দের সুযোগ থাকলে সেখান থেকে একটি বাছাই করা যতটা কঠিন, কোনো পণ্যের পরিমাণ ছয় থেকে ১২ হলে সেটার মধ্যে একটি বাছাই করাটা ততটাই সহজ। আর ইন্টারনেট ডেটিং সাইটগুলো তাদের ক্রেতাদের জন্য অল্পসংখ্যক পছন্দ কখনোই রাখে না, বরং থাকে হাজারো সুযোগ। আর সমস্যাটা হয় এখানেই।

ভালোবাসার সুপার মার্কেট :
বহুল মানুষের ভিড় থেকে নিজের পছন্দের মানুষটি বেছে নেওয়া কিন্তু সহজ বিষয় নয়। ইন্টারনেট ডেটিংয়ের প্রেক্ষাপটে, এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর ড. ফিনকেলের গবেষণায় নেই। কিন্তু স্পিডডেটিং এ বিষয়ে একটি উত্তর দিতে পারে। যেখানে তিনি খুঁজে পেয়েছেন, অনেক পছন্দের মুখে পড়ে যখন একজন ব্যক্তি কাউকে খুঁজে নেওয়ার ক্ষেত্রে চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি কম গুরুত্ব দেয়, বরং পছন্দের মানুষ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাদের উচিত চিন্তা-ভাবনার মধ্য দিয়ে পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ নানা বিষয়ে বাস্তব ধারণা নেওয়া। অন্যভাবে বলতে গেলে, পছন্দ করতে গিয়ে মানুষের মনের ক্ষমতাও কখনো নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে।

ড. ফিনকেলের প্রতিবেদনে যে কথাটা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সেটা হলো, অন্য সবক্ষেত্রের মতো ইন্টারনেটে বসেও ভালোবাসার সন্ধান পাওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। এটা ব্যবহার করতে না জানাটা কোনো কারণ নয়। বরং, সৌভাগ্যবান হলেও আপনার কাছের কোনো রেস্তোরাঁতেও আপনি পেয়ে যেতে পারেন প্রিয় মানুষটিকে। কিংবা, পথের ধারে কাউকে এক পলকে ভালো লেগে গেলে, সে যদি অচেনাও হয়, ছুটে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলুন। কিন্তু মাউস ক্লিক করে যদি ইন্টারনেট থেকে আপনি কাউকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, তবে একদিন দেখবেন, কিউপিডের তীরটি ছুটে এসে আপনার বুকেই বিঁধবে।

আল-জাজিরায় ঘটক পাখি ভাই


বিশ্ব ভালবাসা দিবসে মধ্যপ্রাচ্যের প্রখ্যাত টিভি নেটওয়ার্ক আল-জাজিরার বিশেষ রিপোর্ট। শিরোনাম ‘দ্য সাকসেসফুল ম্যাচ মেকার অব বাংলাদেশ।’ তিনি আর কেউ নন, ঘটক পাখি ভাই। সফল জুটি মেলানোর গোপন সূত্র সম্পর্কে পাখি ভাই বলেন, বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততা। কোন বিষয় লুকিয়ে না রাখা। পাখি বলেন, আমি পাত্র ও পাত্রী পক্ষকে সব খুলে বলি। উভয় পরিবারের পরিচয় করিয়ে দিই। আমার কাজ শেষ। তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করেন। পছন্দ হলে বিয়ে হয়। না হলে হয় না। আর এভাবেই খ্যাতি পেয়েছেন ভালবাসার গুরু হিসেবে। জুটি মেলোনোর সফল কারিগর তিনি। পাখি ভাই। ঘটক। এখন পর্যন্ত জুটি মিলিয়েছেন ১০ হাজারেরও বেশি। মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তার পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন। নায়ক-নায়িকা, ফ্যাশন মডেলের বিয়ে দিয়েছেন। বা-মা তাদের সন্তান এমনকি নাতি-নাতনিরও বিয়ে হয়েছে পাখি ভাইয়ের মাধ্যমে। একটি পরিবারে ২৬টি পর্যন্ত বিয়েতে ঘটকালি করেছেন। দাম্পত্য জীবনে সুখ মন্ত্র হিসেবে তিনি বলছেন, বিশ্বাস আর সততা।
তবে তার আসল নাম কিন্তু পাখি নয়। কাজী আশরাফ হোসেন। অবশ্য এ নামে গত ৪০ বছরে কেউ তাকে ডাকেনি। নিজের আসল নামটা ভুলেই গেছি- বললেন পাখি ভাই। কেন তার নাম পাখি হলো? অকপট উত্তর- পাখির মতো এখানে সেখানে ছুটে বেড়াতাম। কেউ পাত্র বা পত্রী খুঁজছে জানতে পারলেই ছুটতাম তার বাড়ি। এ থেকেই মানুষ আমার নাম দিল পাখি। আমি হলাম ঘটক পাখি ভাই। এ নামেই এখন আমার কোম্পানির নাম। ‘ঘটক পাখি ভাই প্রাইভেট লিমিটেড।’
কোন ধরনের বিয়ে দিয়ে বেশি আনন্দ পান জানতে চাইলে তিনি বলেন- যখন একটা কালো, মোটা, শ্রীহীন মেয়ের জুটি মিলিয়ে দিতে পারি তখন আনন্দ হয়। মনে হয়, একটা ভাল কাজ করতে পারলাম। পাখি বলেন, মানুষের আসল সৌন্দর্য মনে। বাইরের সৌন্দর্য মেকি। তারপরও বেশিরভাগ মানুষ সুন্দর বউ চায়। বলে সুন্দর বউ না হলে বাইরে মুখ দেখানো যাবে না। কিন্তু সুন্দর বউ নিয়েই ঝামেলা বেশি।
সুখী সংসার কেমন জানতে চাইলে পাখি ভাই বলেন- কম টাকা, কম চাহিদা, একে অপরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর ভালবাসা যদি থাকে তবে সেটাই সুখের সংসার। এমন সংসারের স্বাদ যে একবার পেয়েছে সে শুধু জানে জীবনে সে কি পেয়েছে। আর স্বামী যদি মদ খায়, নাইট ক্লাবে যায় তবে সংসারে অশান্তি অনিবার্য। একইভাবে স্ত্রী যদি পর পুরুষের সঙ্গে ঘোরে। ডিস্কোতে নাচে, মদ খায়, সিগারেট টানে তবে সুখ তাদের কাছ থেকে পালায়। সংসার থাকে নামে মাত্র। তারা দু’জনেই জানে তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে অভিনয় করে চলেছে। জীবনভর এ অভিনয় করতে হয়। আবার পাত্রের যদি লোভ থাকে। শ্বশুরের কাছ থেকে অনেক কিছু নেবে- এমন মনোভাব থাকে তবে সে ঠকতে বাধ্য। আবার পাত্রীর মধ্যে যদি হাই-ফাই ভাব থাকে। অহঙ্কার-বড়াই থাকে তবে সেও ঠকবে।
সফল দাম্পত্য জীবনের মন্ত্র কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানেও বিশ্বাস। স্বামী-স্ত্রী যদি একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন তবে সে সংসার কখনই ভাঙবে না। কিন্তু তারা যদি ক্রমাগত একে অপরকে মিথ্যা বলেন, কথা গোপন করেন তবে সে সম্পর্ক ভাঙতে বাধ্য। সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় সম্পর্ক না ভাঙলেও দাম্পত্য জীবনের মৃত্যু ঘটবে। সুখ-শান্তি থাকবে না। তখনই মানুষ হয়ে যায় বাহির মুখী। সুখের খোঁজে মানুষ নদীর ওপারের পানে চেয়ে থাকে।
ঘটকের মাধ্যমে পাত্র-পাত্রী কারা চায় জানতে চাইলে পাখি ভাই বলেন, যে সব মেয়ে জিন্স প্যান্ট পরে, চুলে রং করে রাত-বিরেতে ঘোরে তাদের পাত্রের অভাব হয় না। তাদের অনেকের ৩-৪ বার করেও বিয়ে হয়। কিন্তু যারা নম্র, ভদ্র, লাজুক। যারা প্রেম করতে জানে না বা প্রেম করার ফুরসত পায়নি তারাই আমার পাত্রী। ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই। আবার সংসার ভেঙে গেছে এমন পাত্র-পাত্রীও আছে অনেক।
ঘটক পাখি ভাইয়ের কাছে প্রতি মাসেই শ’ শ’ মানুষ আসে জুটি মিলিয়ে নেয়ার জন্য। এতসব মানুষের নাম, ঠিকানা, পছন্দ মনে রাখা কঠিন। তাই একটি কম্পিউটারে বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করেন তিনি। প্রতিটি ক্লায়েন্টের জন্য দেয়া হয় একটি পাসওয়ার্ড। পাসওয়ার্ড টিপলেই ক্লায়েন্টের সব তথ্য চলে আসে। অবশ্য পাত্র-পাত্রী সম্পর্কে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। চাইলেই যে কেউ যে কোন পাত্র বা পাত্রীর ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারে না। চাহিদা অনুযায়ী উপযোগী পাত্র-পাত্রীর ছবি, তথ্য জানানো হয়।
জুটি মেলাতে গিয়ে কখনও কোন ঝামেলা হয়েছে কি না জানতে চাইলে পাখি বলেন, একবার একটা বিয়ে নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। এক থানার ওসি আমাকে অনেক রাতে ফোন করেছিল। ঘুমের মধ্যে ওসির সঙ্গে একটু খারাপ ব্যবহার হয়ে গিয়েছিল। পরে ওসি আমাকে থানায় ডেকেছিল। হয়রানি হয়েছিল খুব।
৪২ বছর ধরে চলছে পাখি ভাইয়ের ঘটক জীবন। ঘটকালি করতে কেমন লাগে জানতে চাইলে পাখি বলছেন, এটা এখন আমার নেশা। পেয়ার, মহব্বতের কাজ। তাই শুক্রবারও অফিস করি। প্রচণ্ড জ্বর নিয়েও অফিসে বসেছি। একদিন অফিসে না এলে আমার দিন কাটে না। যখন আমার মাধ্যমে একটা বিয়ে হয় তখন শুকরিয়া আদায় করি। মনে হয় একটা সওয়াবের কাজ করলাম। দিনভর ব্যস্ত থাকেন পাখি ভাই। শ’ শ’ ফোন রিসিভ করতে হয়। এজন্য তিনি বেশ ক’জন সহকারী নিয়োগ করেছেন।
পাখির বাড়ি বরিশাল জেলার সদর থানায়। বাড়ি গেলে মানুষ আপনাকে কেমন চোখে দেখে? বাড়ি গেলে অনেকেই এগিয়ে এসে হাত মেলায়। সম্মান দেয়। আমার ছেলেমেয়েদের খোঁজ রাখে। তারা ভাবে আমি ভাল কাজ করি। মানুষের উপকার করি। জুটি মিলিয়ে দিতে পারলে কত টাকা পান? আমার কাছে টাকা বড় নয়। অনেক বিয়ে দিয়েছি যেখানে একটি টাকাও নিইনি। গরিব পরিবারের বিয়ে। আবার একটা বিয়ে দিয়েই ৪ লাখ টাকা পেয়েছি। ১-২ লাখ টাকা তো অহরহ পাই। সেদিনও একটা বিয়ে দিয়ে ২ লাখ টাকা পেলাম। এ আয় দিয়েই আমার সংসার চলে। বাড়ি-গাড়ি করতে পারিনি। তবে ডাল-ভাতের অভাব আমার সংসারে নেই। এখন পর্যন্ত কেমন পরিবারের বিয়ে দিয়েছেন? বিয়ে দিয়েছি মন্ত্রী-এমপির ছেলেমেয়ের, তাদের আত্মীয়দের। পুলিশ কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট, সাংবাদিক, বড় সরকারি চাকুরের বিয়ে দিয়েছি অসংখ্য। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ইউকেসহ বিশ্বের বহু দেশে বাস করা লোকজনের বিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশের এমন কোন জেলা নেই যে জেলায় আমি বিয়ে দিইনি। আবার এমনও আছে বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছে আমার হাতে। এখন তাদের ছেলেমেয়ে এমনকি নাতি-নাতনিরও বিয়ে দিয়েছি। একটি পরিবারের ২৬টি পর্যন্ত বিয়ে দিয়েছি। অনেক পরিবার আমাকে তাদের পরিবারেরই সদস্য মনে করে। আচারে অনুষ্ঠানে ডাকে। আবার এমন ঘটনা অহরহ হয় যে আমার মাধ্যমে পরিচয় হয়েছে, পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমাকে বলে পছন্দ হয়নি। কিন্তু পরে জানতে পারি আমাকে ফাঁকি দিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে। তখন তাদের গিয়ে ধরি। বলি আমার পারিশ্রমিকটা দেন। এ সেদিনও এমন ঘটনা জানতে পেরে লোকজন নিয়ে হাজির হলাম এক কমিউনিটি সেন্টারে। তখন বলল, ভুলে গেছিলাম। সুড় সুড় করে টাকা বের করে দিল। অনেকে আবার আমার মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে এটা লুকাতে চায়। আমাকে বলে বিয়েতে যাবেন না। কাউকে বলবেন না।
পাখি ভাইয়ের অফিসে তার সহকারী হিসেবে সুশ্রী অনেক তরুণী কাজ করছেন। পাত্রী খুঁজতে এসে এসব তরুণীদের কেউ পছন্দ করে ফেলেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে যেসব মেয়েকে আমি কাজ দিই তারা সবাই বিবাহিত। তারা আমার মেয়ের মতো। ১০-১২ বছর ধরে আমার এখানে অনেকেই কাজ করছেন। সম্পূর্ণ পেশাদারি মনোভাব নিয়েই কাজ করে তারা। পাখি ভাইকে নিয়ে দেশে তো বটেই বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। বিবিসি, এএফপি, সিএনএন, গার্ডিয়ান পত্রিকায় ফলাও করে ফিচার ছাপা হয়েছে তাকে নিয়ে। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ বিশ্ব ভালবাসা দিবসে আল জাজিরা তাকে নিয়ে বিশেষ রিপোর্ট প্রচার করেছে। আল জাজিরায় পাখিকে দেখা যায় ফুল হাতে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন পার্কে, লেকের ধারে। আসলেই কি এত সুখের সংসার তার? পাখি বলছেন, আমি বিয়ে করেছি দুটো। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল। তিনি এখনও আমার ঘরে আছেন। তবে ২৭ বছর ধরে তিনি অসুস্থ। পরে আরেক মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। প্রেমই বলতে পারেন। তবে তাতে আমার পরিবার বা তার পরিবারের কোন অসম্মতি ছিল না। প্রথম স্ত্রীর সম্মতি নিয়ে পারিবারিকভাবেই তাকে বিয়ে করেছি। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলেমেয়েদেরও বিয়ে দিয়েছি আমি। পাখি বলেন, আমার দুই স্ত্রী। কিন্তু দু’জনেই আমার কাছে সমান। প্রয়োজনের তাগিদে আমি আরেকটি বিয়ে করেছি। কিন্তু আমার সংসারে সুখের কমতি নেই। আল জাজিরায় রিপোর্ট প্রকাশের পর কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো লেখাপড়া বেশিদূর জানি না। তাই জানতাম না আল জাজিরা কত বিখ্যাত টিভি। ওরা ৪ দিন ধরে স্যুটিং করল। রিপোর্ট প্রচারের পর বিশ্বের কত দেশ থেকে ফোন আসছে। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমার স্ত্রী যারপরনাই খুশি। কোটি টাকা দিয়েও তো এ সম্মান পেতাম না। পাখি ভাই বলেন, ১৯৭৩ সালে ঢাকায় এসেছি। তখন হেঁটে, বাসে চড়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। পরে পুরনো ঢাকায় অফিস নিলাম। সেখান থেকে ইস্টার্ন প্লাজা। এখানে আছি ২২ বছর ধরে। মানুষের ভালবাসা আর বিশ্বাস না থাকলে এতদিন টিকে থাকতে পারতাম না। পাখি ভাই বলেন, তবে সবাই এক নয়। ম্যারেজ মিডিয়ার নামে অনেকে প্রতারণার ব্যবসা খুলে বসেছেন। তাদের কারণে এ পেশার দুর্নাম হচ্ছে। ঘটক পাখি ভাইয়ের বয়স এখন
  ৭০ ছুঁই ছুঁই। ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক তিনি।  দু’ছেলে ও দু’মেয়ের ভাল ঘরে বিয়ে দিতে পেরেছি বললেন পাখি। আরও বললেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ কাজই করে যেতে চাই।
একুশ নিউজ মিডিয়া এখন ফেস বুক এ Video News: www.EkushTube.com Visit us on FaceBook

Cheap International Calls