সারাদেশে যৌন চিকিৎসার ফাঁদ পাতা হাজার হাজার হারবাল ও হোমিও প্রতিষ্ঠান
মে 11, 2012 ১ টি মন্তব্য
খোন্দকার তাজউদ্দিন
মানুষ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে গল্প বলতে এবং শুনতে। আর সেটা যদি কিংবদন্তি হয় তাহলে তো কথাই নেই। এ রকমই একটি গল্প শোনাই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত জাদুকর হাওয়ার্ড থর্সটনকে নিয়ে এই গল্পটি প্রথম চালু হয়। থর্সটনের জাদুর অনুষ্ঠান। দর্শকভর্তি হলরুম। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও জাদুকরের দেখা নেই। ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছেন দর্শক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা। এমন সময় মঞ্চে হাজির হলেন জাদুকর। উত্তেজিত দর্শক দেরি হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করতেই জাদুকর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন ‘কই’ আমি তো এক মিনিটও দেরি করিনি’। দর্শকরাও নিজেদের হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, একটু আগে দেখা সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা পিছিয়ে গেছে! বিস্ময়কর এই ম্যাজিকে হলভর্তি দর্শক তুমুল হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালেন জাদুকরকে। পরবর্তী সময়ে এই গল্পটি অনেক খ্যাত-অখ্যাত জাদুকরকে নিয়েও শোনা যায়। জুয়েল আইচ বা ডেভিড কপারফিল্ডের জাদু আমাদের বিস্ময়কর জগতে নিয়ে যায়। তাদের জাদু দেখে আমরা মুগ্ধ হই, হই শিহরিত। ধরে নিই এবং বিশ্বাস করি জাদু দিয়ে যে কোনো কিছুই করা সম্ভব।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, উপরে যে জাদুটির কথা বলা হলো, তার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোনো দিনই ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়ার এই জাদু দেখানো হয়নি। তারপরও পিসি সরকারের এমন জাদু নিজে দেখেছেন এমন প্রত্যক্ষদর্শীও এ দেশে আছেন। এটা কী করে সম্ভব? যে জাদু কখনো দেখানো হয়নি সে জাদু দেখেছেন কীভাবে? ওই যে বললাম গল্প বলা এবং শোনা মানুষের সবচেয়ে প্রিয় অভ্যেসÑ তা সে সত্যি-মিথ্যা যা-ই হোক। আসলে আমরা একটি গল্প শোনা বা বলার আগে যুক্তি দিয়ে ভাবি না। একটু শুনে তার সঙ্গে আর একটু যোগ করে গল্পটিকে আকর্ষণীয় করতে ভালবাসি। গল্প বলে সবাইকে চমকে দিয়ে আড্ডার মধ্যমণি হতে চাই। মধ্যমণি হতে গিয়ে কিছু মিথ্যা কুসংস্কারকে সত্যে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। অন্যের মুখের শোনা ঘটনাকে নিজের দেখা বলে গর্বের সঙ্গে গল্প করি। এভাবেই তৈরি হয় অতিরঞ্জিত কাহিনী, যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় কিংবদন্তির। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। এক পর্যায়ে অনেক মানুষের মনে করে নেয় বিশ্বাসের আসন।
এক সময় পাহাড়, সমুদ্র, আগুন, নদী, ঝড় সব কিছুকেই মানুষ বসিয়েছিল দেবতার আসনে। চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, শনি প্রভৃতি নক্ষত্র এবং গ্রহগুলোকে মানুষ পূজা করত দেবতা হিসাবে। মানুষের জানা ছিল না জীবাণুর অস্তিত্ব সম্পর্কে। অসুখকে মানুষ মেনে নিয়েছে নিয়তি হিসেবে। ভেবে নিয়েছে পাপের ফলই অসুখ। তন্ত্র-মন্ত্র, তেলপড়া, পানিপড়া ঝাড়ফুঁক ¯^প্নে পাওয়া ওষুধের দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু এ তো অনেক অনেক যুগ আগের কথা। এখন তো অলৌকিক অনেক কিছুই মানুষের নাগালের মধ্যে। পৃথিবী জয় করে মানুষ এখন বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছে মঙ্গল গ্রহে। এত কিছুর পরও কিছু মানুষ এখনো রয়ে গেছে সেই তন্ত্র-মন্ত্রের যুগে। সে মানুষগুলো যুক্তি নয়, সব কিছু বিচার করে কুসংস্কার আর প্রচলিত ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে। সেই মানুষগুলো আমরা। বিনোদনের জন্য জাদুকর জাদুর খেলা দেখায়। এটা তার পেশা। সেই খেলা দেখে আমরা বিস্মিত হই। আনন্দ পাই। আধুনিক জাদুকরাও বলেন, এগুলো বিশেষ ধরনের কৌশল। চেষ্টা করলে অনেকের পক্ষেই অনেক কিছু আয়ত্ত করা সম্ভব। এর মধ্যে অলৌকিক শক্তির কোনো বিষয় নেই। কিন্তু আমাদের সমাজে একশ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা এই স্বাভাবিক লৌকিক ঘটনাগুলোকে অলৌকিক কর্মকাণ্ড হিসাবে আখ্যা দেয়। অল্প শিক্ষিত, শিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে বিভ্রান্ত করে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ব্যবহার করে ধর্মকে। লৌকিক ঘটনাকে বানিয়ে ফেলে পারলৌকিক। নিম্নশ্রেণীর কিছু জাদু দেখিয়ে নিজেরা আয় করে লাখ লাখ টাকা। অসহায় মানুষ তাদের এই অলৌকিক প্রচারণায় মুগ্ধ হয়ে তুলে দেয় তার শেষ সম্বল। হয়ে যায় নিঃস্ব।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য রাজধানী শহর ঢাকায় চলছে লৌকিক-পারলৌকিক এমন অনেক বাণিজ্য। গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সাপের মণি। অথচ ‘সাপের মণি’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই পৃথিবীতে! আপনার কী বিশ্বাস হয় মানুষ জারজ সন্তানের হাড়ের তাবিজ কেনে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে?!! ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয় কালো কুত্তার দাঁতের তাবিজ?!
ঘটনার ভেতরে প্রবেশ করা যাক। যার কথা বলছি তার আসল নাম বলছি না। বলছি না এই কারণে যে, তিনি নাম প্রকাশ করতে চান না। ধরে নিই তার নাম আবদুস সালাম। তিনি একটি স্টেশনারি দোকানের মালিক। শ্বশুরবাড়ির টাকায় এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এক বছরের মধ্যে লোকসান হয়েছে ২ লাখ টাকা। একজনের মাধ্যমে শুনেছেন সাপের মণির আংটি ব্যবহার করলে মাত্র ১৪ দিনের মধ্যে তার সব ক্ষতি পুষিয়ে যাবে। কেটে যাবে আর্থিক অনটন। ব্যবসায় শুধু থাকবে লাভ আর লাভ। সালাম সাহেবের অবস্থা তখন খুবই খারাপ। শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে পারছেন না। এ অবস্থায় তিনি গেলেন ‘খানকায়ে শেফায়’। ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে আনলেন সাপের মণি। এই সাপের মণি কিনে আনার কাহিনী তার কাছ থেকে শুনলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, বিষয়টি নিজেরই জানতে হবে। পত্রিকায় দেওয়া খানকায়ে শেফার বিজ্ঞাপনটি ভালো করে পড়লাম। এই খানকায়ে শেফার সাধক সুফিয়া বেগম। তিনি বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছেন এশিয়া মহাদেশের ভেতরে একমাত্র আধ্যাত্মিক তান্ত্রিক মহিলা…। যে কোনো সমস্যা সে যত কঠিনই হোক না কেন তিনি আধ্যাত্মিক ঘটনা ও ক্ষমতার বলে সমাধান দিয়ে থাকেন। বিজ্ঞাপনে যে সমস্যাগুলোর কথা লিখেছেন সেগুলোর কয়েকটি এমন স্বামী স্ত্রীর অমিল, প্রেম-ভালোবাসায় ব্যর্থতা, যে কোনো লোককে বশ করা, শত্রুকে পরাস্ত করা, মনের মানুষকে কাছে পাওয়া, বিয়ে হয় না, বিয়েতে বাধা, ব্যবসায়ে লোকসান, বানমারা, বান ফেরানো ইত্যাদি। পৃথিবীতে এমন কোনো সমস্যা নেই যে তিনি সমাধান করতে পারেন না। সালাম সাহেবের কল্যাণে বিজ্ঞাপনটি পড়লাম এবং যারপরনাই চমকিত হলাম।
খানকায়ে শেফার অবস্থান মগবাজার রেল ক্রসিংয়ের পাশে। গত ১৬ ফেব্রæয়ারি সকাল ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে হাজির হলাম সুফিয়া বেগমের দরবারে। গ্লাসের দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, সোফায় সাদা পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরিহিত একটি লোক বসা। বললেন, মা’র সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। সিরিয়ালে নাম লেখালাম। সিরিয়াল নম্বর ৯। অর্থাৎ আমার আগে আজকে আরো ৮ জন এসেছে। পাশ থেকে এক যুবক ধমকের সুরে বললেন ২৫ টাকা দেন। কিসের টাকা? যার সঙ্গে দেখা করার ফি বাবদ ২০০ টাকা। এটা নাম লেখানোর সঙ্গে সঙ্গেই দেওয়ার নিয়ম। না দিলে মা কষ্ট পাবে। এতে ক্ষতি হবে। একসময় ডাক এলো। বসলাম সুফিয়া বেগমের সামনে। গদিওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন মাথায় ঘোমটা। চোখ বন্ধ, মাথা নিচু করে আছেন। প্রায় এক মিনিট পরে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন আপনার সমস্যা কী বলেন বাবা?
তেমন কোনো সমস্যা নয়। ব্যবসায় লাভ হচ্ছে না।
‘কিসের ব্যবসা’?
বিজ্ঞাপনী সংস্থার।
কী ব্যবসা করেন?
বোঝা গেল তিনি বিজ্ঞাপনী সংস্থার বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। বুঝিয়ে বলার পর বললেন, ঠিক আছে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কোনো চিন্তা নেই।
চোখ বন্ধ করে একনাগাড়ে বলে গেলেন আমি আপনার ইমান দেখেছি। আপনি সত্যবাদী ও ইমানদার মানুষ। ইমান শক্তিশালী করার জন্য আমার কাছে এসেছেন। যান এক বোতল পানি নিয়ে আসেন।
বললাম, আমার নিজের যেতে হবে না টাকা দিলে অন্য কেউ কিনে আনতে পারবে?
‘না আপনার নিজেরই যেতে হবে, যান।’ বললেন ধমকের সুরে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ১০ টাকা দিয়ে এক বোতল পানি কিনে আনলাম।
বোতল খুলে ডান হাতের তালুতে একটু পানি নেন।
ডান হাতের তালুতে পানি নিলাম। পানিতে তিনি দুই আঙুল ডুবিয়ে কিছু একটা ঘষতে থাকলেন। মুখে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে যাচ্ছেন। বিসমিল্লাহ আল্লাহ, আবদুল কাদের জিলানী খাজাবাবা, মা কালী ইত্যাদি শব্দ বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম মিলিয়ে দোয়া পড়ছেন।
আপনার এই পানি যদি তিতা বা টক হয়, তাহলে আপনার মুশকিল আসান আমি করব না। আর যদি আপনার পানিতে কোনো আল্লাহ হুজুরপাক মা কালীর আশীর্বাদে কোনো কুদরত এসে থাকে তাহলে আপনার মুশকিল আসান আমার মাধ্যমে হবেই হবে। পানিটা এক চুমুকে খেয়ে ফেলুন।’
সুফিয়া বেগম তার ময়লা দুটি আঙুল পানিতে ডুবিয়েছেন। আঙুলে কিছু একটা নিয়ে অনেকক্ষণ ঘষেছেন। ফলে পানিটা ঘোলা হয়ে গেছে। না খেয়ে ইতস্তত করছি। তিনি বলে উঠলেন, তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলেন। না খেলে আপনার অমঙ্গল হবে।
আরো অনেক কিছু জানতে হবে, এ কারণে তীব্র অরুচি এবং অনিচ্ছা সত্তে¡ও পানিটা খেলাম। খেতে গিয়ে অবশ্য ইচ্ছে করে বেশি অংশ ফেলে দিলাম। এতে তিনি কিছুটা বিরক্ত হলেন। ‘পানির স্বাদ কেমন বাবা?’ প্রশ্ন করলেন সুফিয়া বেগম।
মিষ্টি স্যাকারিন দিলে যেমন হয় তেমন মনে হলো।
তওবা আস্তাক ফেরউল্লাহ। এ কথা বলবেন না। আপনার ওপর আল্লাহর রহমত নেমে এসেছে। তাই পানির স্বাদে পরিবর্তন এসেছে। সুস্বাদু হয়েছে।
এরপর প্রায় এক মিনিট বিরতি। কাগজে কিছু একটা আঁকাআঁকি করছেন। কথা বলতে নিলে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন, আপনার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আপনি এখন কী ভাবছেন সেটাও দেখতে পাচ্ছি। আপনার ব্যবসার শুরুটা তো খুবই ভালো হয়েছিল। খুবই ভালো। আপনার কাজের শুরুটা ভালো, শেষটা ভালো না, আপনি খুব বড় মনের মানুষ। আপনি সবাইকে দিয়ে খুশি হতে চান। কিন্তু আপনাকে কেউ বুঝতে পারে না। সামনে যে আপনার বন্ধু, পেছনে সেই আপনার পিঠে ছুরি মারতে চায়। কিন্তু আপনি সেটা বুঝতে পারেন না। আপনার ওপর রাহু এবং শনির প্রভাব আছে। এ কারণে বৃহস্পতি দূরে সরে যাচ্ছে। এখনই বৃহস্পতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাড়াতে হবে রাহু আর শনিকে।
রুমে ঢুকলেন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটি। বসলেন আমার পাশের চেয়ারে। রাহু ও শনি তাড়ানো বিষয়ে আরো অনেক কথা বললেন। আমার সম্পর্কে বললেন আরো অনেক ভালো ভালো কথা। যা শুনতে বেশ ভালোই লাগে। এত ভালো কথা নিজের সম্পর্কে জীবনে শুনিনি। আমাকে প্রায় ফেরেশতার পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। আবার কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে গম্ভীরভাবে বলে উঠলেন, ‘দুই হাত মাথার ওপরে উঁচু করে ধরুন। এক হাতে সুখ আর এক হাতে দুঃখ নিয়ে মুঠ করে ধরুন।’
হাত মুঠ করে বসে আছি। সুফিয়া বেগম কাগজে দাগ কাটছেন। স্বাভাবিকভাবে যেটা করার কথা সেটা না করে সুখ-দুঃখ ধরার ক্ষেত্রে আমি উল্টোটা করেছি। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছেন, বুঝতে পারছি না। জোরে বলে উঠলেন, ‘আপনি ডান হাতে সুখ আর বাম হাতে দুঃখ ধরেছেন। ঠিক বলেছি? বলেন, আলহামদুলিল্লাহ।’
মানুষের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার রহস্যটা বুঝতে পারছি। স্বাভাবিক বিশ্বাসে যারা সুফিয়া বেগমের কাছে যাবেন তাদের প্রায় সবাই ‘সুখ’ ডান হাতেই ধরবেন, বাম হাতে নয়। সুফিয়া বেগমের কথার সঙ্গে মিলে যাবে। ফলে তার প্রতি বিশ্বাস আরো দৃঢ় হবে।
আপনি কী সাপের মণি নিতে পারবেন?
সাপের মণি কোথায় পাব কীভাবে নেব? বললাম আমি।
এবার তিনি গর্জন করে উঠলেন, এত কথা বলবেন না। আর বেশিক্ষণ সময় নেই। সাপের মণির ব্যবস্থা আমি করব। আপনার সাহস হবে ব্যবসায় উন্নতি হবে। শত্রু আপনার সামনে এসে পা জড়িয়ে ধরে মাফ চাইবে। বড় সাপের মণি নিতে চাইলে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা লাগবে।
সাপের মণি কি এখন দেখা যাবে?
না না না। এই জিনিস বাইরে রাখা যায় না। এটা আছে সাপের মাথার ভেতরে। আপনি এখন কিছু টাকা অ্যাডভান্স করে যাবেন। যাদের কাছে মণিওয়ালা সাপ আছে তাদের খবর দিলে সাপ নিয়ে আসবে। আপনি ব্লেড দিয়ে কেটে সাপের মণি বের করে নেবেন। একজন বিভিন্ন সাইজের আংটি নিয়ে এসে আমার হাতের মাপ নিলেন।
‘তা এখন কত টাকা অ্যাডভান্স করবেন বাবা?’
‘এখন আমার কাছে টাকা নেই। কালকে এসে নিয়ে যাব।’
‘আমার কাছে মিথ্যা বলবেন না বাবা। আপনার মানিব্যাগে ৫শ টাকার নোট দেখতে পাচ্ছি।’
ম্যানিব্যাগ আমার আর উনি ৫শ টাকার নোট দেখতে পাচ্ছেন। আসলে আমি যখন ২শ টাকা ফি দিচ্ছিলাম তখন একজন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার মাধ্যমে খবরটা চলে গেছে সুফিয়া বেগমের কাছে। বললাম, ‘এটা আমার টাকা নয়, অন্যজনের। টাকাটা আজই দিতে হবে। আমি কালকে টাকা নিয়ে আসব।’
‘আজকে কিছু অ্যাডভান্স করে গেলে আপনার মঙ্গল হতো। আচ্ছা ঠিক আছে কালকে আসেন। আপনার মোবাইল নম্বরটা লিখে দিয়ে যান।
বললাম, সাপের মণি নিলে আমার বিদেশ যাওয়া হবে কি না? তিনি বললেন আপনি অনেকবার বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বৃহস্পতি আপনার সঙ্গে ছিল না। আপনি সাপের মণি ব্যবহার করলে একুশ দিনের মধ্যে বিদেশ যেতে পারবেন।
প্রায় ৩০ মিনিট পরে বেরিয়ে এলাম খানকায়ে শেফা থেকে। আমার ক্ষেত্রে যে ঘটনাগুলো ঘটল প্রায় হুবহু গল্প শুনেছিলাম সালাম সাহেবের কাছ থেকে।
সুফিয়া বেগম কতটা আধ্যাত্মিক, কতটা ক্ষমতাবান তা তার কথার মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
মানুষের নানা কিসিমের গোপন রোগের বিদ্যুৎগতিতে সমাধান দেয়া ও ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়ার নামে গড়ে উঠেছে দাওয়াখানা, হারবাল চিকিৎসা ও হোমিও চিকিৎসালয়। এ চিকিৎসায় বিতরণ করা হয় লিফলেট, যা অশ্লীল ও অশ্রাব্য। এসব লিফলেটের নিচে লেখা থাকে বিভিন্ন দাওয়াখানা হারবাল ও হোমিও চিকিৎসালয়ের ঠিকানা। ভাগ্য ফেরানোর কারিগরদের নামের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে অদ্ভুত ধরনের ডিগ্রি ও মেডেল প্রাপ্তির ইতিহাস, যৌন রোগ ও ভাগ্যবদল করার ব্যানারেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। প্রশাসনের সামনেই এসব ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তারা নির্বিকার। মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে এরা ব্যবসা করে যাচ্ছে দেদার।
ওষুধ প্রশাসনের হেঁয়ালি ও আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে এবং মানুষের গোপনীয় ও ব্যক্তিগত দুর্বলতা পুঁজি করে সারাদেশে ভেজাল, অকার্যকর ও মানহীন ওষুধের রমরমা বাণিজ্য হচ্ছে।
জানা গেছে, ভাগ্য ফেরানোর নামে গড়ে ওঠা দাওয়াখানা, হারবাল ও হোমিও চিকিৎসালয়ের অধিকাংশের ট্রেড লাইসেন্স নেই। তারপরও ওষুধ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয় না।
ধর্মকে ব্যবহার করে বাণিজ্য করার প্রবণতা প্রাচীনকাল থেকে। এক দল ধর্মব্যবসায়ী ধর্মের ব্যানারে মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্বলতা পুঁজি করে ধান্ধাবাজি করে। ভণ্ড পীর-ফকিরের ব্যানারে তারা নিয়মিত প্রতারণা করছে। গ্রামগঞ্জেও এই টাউট-বাটপারদের অবাধ বাণিজ্য। এই টাউট-বাটপাররা ক্রমেই গ্রাম ছেড়ে শহরে আস্তানা গড়ে তুলেছে। জন্ম দিচ্ছে হুজুর সাইদাবাদী, সুফিয়া বেগম, জীবন চৌধুরীদের। এদের অবশ্য এই ব্যবসা করতে সরকারের অনুমতি নিতে হয় না। সরকারকে তারা ট্যাক্সও দেয় না। তারা ট্যাক্স দেয় এলাকার মস্তানদের। নিয়মিত মাসোয়ারা দেয় সংশ্লিষ্ট থানাকেও। যে কারণে সগৌরবে চলছে এই প্রতারণার ব্যবসা।
‘মনের কষ্ট আর নয় বনে বনে’ অথবা হতাশ জীবনে অমাবস্যা আঁধারের মাঝে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নাময় পূর্ণিমায় যেন হয় আপনার দর্শন কিংবা ‘জীবনের শেষ দর্শন’ এ রকম বিচিত্র স্লোগান দিয়েই ফাঁদ পাতা হচ্ছে প্রতারণার।
ধর্মীয় অনুভ‚তি কাজে লাগিয়ে লৌকিক-পারলৌকিক ব্যবসা যেসব স্থান থেকে হচ্ছে সেগুলো হলোÑ আল্লাহর দান, বাস্তব কাহিনী, দরবারে পীরানী, দরবারে আশেক, কামরূপ কামাক্ষা, যজ্ঞমন্দির, আলি কাদিরী দরবার শরীফ, দস্তগীর পীরের দরবার, শেষ ভাগ্য নিবাস, আশেকানে সমাধান, দরবারে মুক্তি, দরবারে শান্তি, চন্দ্রমণি, কোরাইশী দরবার শরীফ, দরবারে সুলতান শরীফ, রহমানিয়া দরবার শরীফ, দারুল উলুস মাদ্রাসা ও দরবার শরীফ, জান্নাতি দরবার শরীফ, আল্লার দান দরবার শরীফ, হাজী বিল্লাল মিসরী দরবার শরীফ, পায়রা পাথর ঘর, শারা হারবাল কেয়ার, আল নূর, শেরে আলী দরবার শরীফ, ফুরফুরা খানকা শরীফ, স্বপ্ননিবাস দরবার শরীফ, তদবিরে শেফা, বিস্ময় বালক, কালীমন্দির, দরবারের আল তকদীর, গাউছে পাক দরবার শরীফ, মোহাম্মদীয় পাক দরবার শরীফ, আল আহসানিয়া খানকা শরীফ, মুসলিম পাক দরবার শরীফ, স্বপ্নের দরবার, দিকদর্শন, শেষ দিকদর্শন, শেষ দর্শন, আজমেরী জেমস হাউস, আল ফরিয়াদ, স্বপ্ন বাস্তবায়ন দরবার, বৌদ্ধ বাবুর আশ্রম, ক্ষ্যাপা সাধুর আশ্রম, মণিঠাকুরের আস্তানা, শেষ ভরসা কেন্দ্র, জান্নাতি দরবার, মা কালীমন্দির, সর্পরাজের দরবার, সর্প-সম্রাটের শেষ দর্শন, রুহানী দরবার শরীফ প্রভৃতি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে খোঁজ নিয়ে নিয়ে জানা যায়, লৌকিক পারলৌকিক এ ব্যবসার মূল লক্ষ্য পাথর বিক্রয়। ক্ষেত্র বিশেষে এ পাথর কয়েক লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। এর বাইরে সাপের মণির নামে নেয়া হয় ১ লাখ টাকা। জারজ সন্তানের হাড় ৫০ হাজার টাকা, কালো কুত্তার দাঁত ৬০ হাজার টাকা। তাবিজ ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। মূলত এগুলো বিক্রি করার জন্যই লোক সংগ্রহ করা হয়। তাদের কাছে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন অন্যতম লক্ষ্য।
হারবালের নামে প্রতারণা
রাজধানীতে হারবাল চিকিৎসার নামে চলছে প্রতারণা। নামে-বেনামে বিভিন্ন স্পটে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক চিকিৎসা কেন্দ্র। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হারবাল ওষুধের ইউনানি দাওয়াখানার নেই কোনো ট্রেড লাইসেন্স। অধিকাংশ রোগী চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে এসে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে যৌনরোগ, পাইলস, অ্যাজমা, গ্যাস্ট্রিক ও ক্যান্সারসহ অনেক রোগের চিকিৎসার কথা বলে প্রতারিত করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। যারা এই চিকিৎসাসেবার সঙ্গে জড়িত তাদের অনেকেরই হারবাল বা গাছগাছড়া সংক্রান্ত তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। হারবাল চিকিৎসার দাওয়াখানা দিয়ে কবিরাজ কিংবা হেকিম বনে গেছেন। এসব চিকিৎসক নিজের নামের আগে ও পরে যুৎসই বড় বড় ডিগ্রি, বিশেষজ্ঞ ও বিশেষণ বসিয়ে রোগীদের ফাঁদে ফেলছেন।
বর্তমানে রাজধানীতে একশ্রেণীর মহিলা দ্বারা কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে বাসের যাত্রীদের কাছে যৌন চিকিৎসার বিজ্ঞাপন তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টার পাশাপাশি পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে রোগীরা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা কবিরাজের শরণাপন্ন হলেও রোগ থেকে পরিত্রাণ মিলছে না । বরং আরোগ্য না হয়ে আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন জটিল রোগে।
ফর্সা হওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছে কারওয়ান বাজারের হাফিজিয়া ম্যানশনের জেনুইন হারবাল। মাত্র ১শ টাকায় রোগীর ত্বক পরীক্ষা করে ফর্সা হওয়ার ওষুধ দিচ্ছে। প্রথম ফাইল ১২শ’ টাকা। প্রয়োজনে সঙ্গে দেন বিশেষ ক্রিম। চিটাগাংয়ের দেওয়ানহাট মোড়ের অ্যাজমা কমপ্লেক্সের ইবনে সিনা হারবাল সেন্টার লিমিটেড লম্বা, মোটা, ফর্সা যা-ই হতে চান তার ওষুধ আছে। বাংলাদেশের যে কোনো প্রাš— থেকে তাদের ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে। তবে এজন্য প্রথমে বিজ্ঞাপনে দেওয়া ৩২০৮০৩২৫ নম্বরে ডাক্তারের নির্দেশ অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ফ্লেক্সিলোড করতে হয়। পরে ফোন করে ঠিকানা জানালে সে অনুযায়ী এসএ পরিবহনের মাধ্যমে ওষুধ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সার্ভিস চার্জসহ প্রতি কোর্সের দাম পড়ে মাত্র ১ হাজার টাকা। চিকিৎসালয়ের পরিচালক জানান, ‘কোনো অভিযোগ থাকলে বা ভুয়া হলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আমরা ব্যবসা করতে পারতাম না।’ ফ্লেক্সিলোড কেন করতে হয়, এর উত্তরে তিনি জানান, এসএ পরিবহনে পার্সেল করার খরচ নেওয়া হয় বলে তিনি জানান।
লম্বা হতে চাইলে মালিবাগ রেলগেটের পাশেই হারবাল সেবা কেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে অভিনব দুই ধরনের ওষুধ। এর মধ্যে রয়েছে একটি লোশন যা প্রতিদিন পায়ের পাতায় দিতে হবে। এছাড়া রয়েছে ট্যাবলেটের ব্যবস্থা, যার জন্য খরচ হবে ২ হাজার টাকা। নিয়মিত এ চিকিৎসা চালিয়ে গেলে ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি লম্বা হওয়ার নিশ্চয়তা দিলেও উপস্থিত আগন্তুকদের চিকিৎসার উপকারিতা সম্পর্কে কোনো তথ্য কেউই দিতে পারেনি। উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে চিকিৎসা নিতে আসা আসলাম জানান, চিকিৎসকের কথামতো ২ হাজার টাকা খরচ করেও তিনি কোনো উপকার পাননি।
তাঁতীবাজার মোড়ের মাদ্রাজ হারবালে যৌন সমস্যার সমাধানে এক রোগীকে ১৫ দিনের ওষুধের জন্য ৫ হাজার টাকার মৌখিক চুক্তি করা হয়। এ ব্যাপারে রফিকুল ইসলাম নামে এক রোগী অভিযোগ করে বলেন, যৌন সমস্যার জন্য গত ১৫ দিনে ওষুধ খেয়েও তার কোনো লাভ হয়নি।
নগরীর ফার্মগেট মোড়ে হারবাল চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, চেম্বার খুলে এক রুমে বসে আছেন ‘ডাক্তার’। পাশের রুমে যৌনরোগ এবং স্তনের চিকিৎসা হয়। এই রুমে রোগী আর ডাক্তার ছাড়া কেউ ঢুকতে পারে না। রোগীদের সঙ্গে রোগীর নিজস্ব কোনো লোককেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে রিসেপশনিস্ট জানান, ডাক্তার কথা বলতে রাজি নন।
এছাড়াও উত্তর জুরাইন পাইপ রাস্তার বিজয় ইউনানি দাওয়াখানা মেদভুঁড়ি কমানোর জন্য বিশেষ ওষুধ দিয়ে থাকে। দরদাম প্রতিফাইল হাজার-১২শ থেকে শুরু।
গুলিস্তান এলাকায় যৌন শক্তিবর্ধক ও বিভিন্ন জটিল রোগের মহৌষধ নামে কথিত বনাজী হালুয়া, তেল ও বটিকা বিক্রি করেন ‘কবিরাজ’ মোঃ মহসিন। জানা যায়, তার মানিকনগর এলাকায় হালুয়া তৈরির কারখানা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সহজ-সরল মানুষের কাছে বিভিন্ন চটকদার কথাবার্তা বলে এবং নারী-পুরুষের অশালীন ছবি দেখিয়ে এসব হালুয়া ও বটিকা বিক্রি করে আসছেন। এই হালুয়া ও বটিকা বিষাক্ত কেমিক্যাল সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়। এ ধরনের হালুয়া ও বটিকা খেয়ে মানুষের কিডনি এবং লিভার নষ্টসহ জটিল রোগব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ কয়েকজন চিকিৎসক জানান।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মালিবাগ, মৌচাক, মগবাজার, গুলিস্তান, সদরঘাট, মহাখালী, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন স্পটে গড়ে উঠেছে নানা নামে হারবাল চিকিৎসা কেন্দ্র। এসব চিকিৎসা কেন্দ্রের রোগীদের মধ্যে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের সংখ্যাই বেশি। আবার যৌন চিকিৎসার জন্য মধ্যবয়সীর চেয়ে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাটা বেশি বলে জানালেন যাত্রাবাড়ী হারবাল চিকিৎসা কেন্দ্রের এক ডাক্তার। জানা গেছে, অবৈধ মেলামেশা করে চুলকানি, ক্ষত এবং যৌন কাজে অক্ষমতাসহ বিভিন্ন রোগের সমাধানের জন্য অনেকেই গোপন চিকিৎসা নিতে আসেন এসব নামসর্বস্ব চিকিৎসা কেন্দ্রে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক জানায়, যৌন সমস্যার জন্য যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে ওষুধ খেয়ে সে কোনো রকমের উপকার পায়নি। প্রথমে মাত্র সাত দিনে সমস্যা উপশমের কথা বলা হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে রোগ উপশম না হওয়ায় তাকে ৬ মাসের কোর্স কমপ্লিট করতে বলা হয়। আর এক সপ্তাহে ওষুধ বাবদ রাখা হয় ২ থেকে ৪ হাজার টাকা। ডাক্তারের ভিজিট বাবদ কোনো টাকা নেয়া হয় না। তবে ওষুধের মাধ্যমে সেই টাকা নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করে অনেক রোগী।
গত কয়েক বছরে সারাদেশে যৌন চিকিৎসার ফাঁদ পাতা হাজার হাজার হারবাল ও হোমিও প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠলেও ২০০৩ সালের পর এসবের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি। ওষুধ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী ২০০৩-এর পরে ঢাকার বাইরের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অন্যদিকে ড্রাগ কোর্টের তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে ১টি ও ২০১০-এ ৩টি মামলা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী ওষুধ বিক্রেতা বা উৎপাদনকারী সব প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন নিতে হয়। উৎপাদনকারী প্রতিটি ওষুধ প্রচারের জন্য নিতে হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন। কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কা না করে যৌন চিকিৎসার ফাঁদ পেতেছে কথিত হোমিও এবং হারবাল প্রতিষ্ঠানগুলো। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬ থেকে ১৭টি হারবাল প্রতিষ্ঠান এবং ৬০টির মতো হোমিও প্রতিষ্ঠান অনুমোদন নিয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ রুহুল আমিন জানান, ভেজাল ওষুধ প্রমাণের জন্য ড্রাগ প্রশাসন প্রথমে অভিযুক্ত ওষুধটি সংগ্রহ করে থাকে। তারপর ল্যাবে পাঠায়। এরপর রিপোর্ট যাওয়ার পর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে জবাব মনঃপূত না হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ ব্যবস্থায় আবার ৩টি ধাপ রয়েছে। প্রথমত অভিযুক্ত ওষুধটির উৎপাদন স্থগিত, দ্বিতীয়ত রেজিস্ট্রেশন স্থগিত, তৃতীয়ত অভিযুক্ত ওষুধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের। এরপর মামলার দীর্ঘসূত্রতা। অতঃপর অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়া।
এদিকে ওষুধ বিষয়ক অপরাধের জন্য ১৯৮২ সালে ড্রাগ কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হলেও ভেজাল বা অনুমোদনহীন কোনো ওষুধ অথবা বিজ্ঞাপনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত কারো মামলা আমলে নিতে পারবে না সংশ্লিষ্ট আদালত। আইন অনুযায়ী মামলা দায়ের করার অনুমোদিত কর্তৃপক্ষ হলো ড্রাগ প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মামলা দায়ের করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। এসব জটিল প্রক্রিয়া ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা সংক্ষুব্ধ কেউ মামলা করতে যান না। ড্রাগ কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ কোর্টে ৩০টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে মাত্র ৬-৭টি মামলা মানহীন ও ভেজাল ওষুধের জন্য। বাকিগুলো অননুমোদিত বিজ্ঞাপনের জন্য। তবে ২০১০ সালের পর আর কোনো মামলা এ আদালতে দায়ের করা হয়নি।
২০০৩ সাল পর্যন্ত ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ঢাকা ও অন্যান্য স্থানের যে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করেছে সেগুলো হলো চট্টগ্রামের হাকিম শাহ আলম চৌধুরীর মেসার্স জীবনের শেষ চিকিৎসা, হাকিম খায়রুল বশর চৌধুরীর জীবনের শেষ চিকিৎসা, কবিরাজ এয়াকুব আলী চৌধুরীর জীবনের শেষ চিকিৎসা, হাকিম হাজী নূর আহমদ চৌধুরীর জীবনের শেষ চিকিৎসা, ঢাকার মেসার্স মগবাজার চিকিৎসালয়, স্বাস্থ্যই সম্পদ, মেসার্স ঢাকা ইউনানি সেন্টার, মেসার্স দি ইউনানি রিসার্চ সেন্টার, মেসার্স হোমিও হেলথ সেন্টার, নাটোরের মেসার্স জীবন শক্তি হাকিমী ঔষধালয়, মেসার্স সাধক জ্যোতিষী, মেসার্স এফ এ চিকিৎসালয়, মহাখালীর মেসার্স হেলথ অ্যান্ড সেক্স ডেভেলপমেন্ট পয়েন্ট, আর কে মিশন রোডের মেসার্স লাইফ কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, বেইলি রোডের এইচ এম ক্লিনিক পয়েন্ট, মেসার্স হেয়ার লাইফ, মেসার্স চায়না হারবাল হোম, মেসার্স বিডি ল্যাবরেটরিজ, মেসার্স ইবনে সিনা হারবাল সেন্টার, মেসার্স নেচার হিলিং, মেসার্স মঘা ঔষধালয়, মঘা শাস্ত্রীয় দাওয়াখানা, মেসার্স মডার্ন হারবাল রিসার্চ গার্ডেন, মেসার্স তুষিন ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স আলম ম্যানুফ্যাকচারিং। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৪ ধারা লক্সঘন ও ১৯৯৭ সালের সংশোধিত একই আইনের ২১ ধারা মোতাবেক অননুমোদিত বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য মামলা করা হয়েছে। তাদের প্রস্তুতকৃত কোনো ওষুধের জন্য মামলা হয়নি। এসব মামলার মধ্যে মেসার্স হেয়ার লাইফ ও মেসার্স সাধক জ্যোতিষীর নামে অননুমোদিত বিজ্ঞাপনের জন্য, মেসার্স মডার্ন হারবাল রিসার্চ গার্ডেনের বিরুদ্ধে কস্তুরীর জন্য মামলা করা হলেও সেগুলো উচ্চ আদালত স্থগিত করে দেন। এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র মোঃ রুহুল আমিন বলেন, স্বল্প সংখ্যক জনবল নিয়েও তারা কাজ করার চেষ্টা করছেন। জনবল বাড়ানো গেলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতো। চিকিৎসার নামে প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে নিয়মিত মনিটরিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, জনবল সঙ্কটের জন্য তারা তা করতে পারছেন না।
ড্রাগ কোর্টের স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, রাস্তায় চলার পথে বিভিন্ন হারবাল ও হোমিও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখলে মনে হয়, পুরো দেশ বুঝি যৌন রোগে আক্রান্ত। এসব প্রতিষ্ঠানকে কঠোর আইনি ব্যবস্থার মধ্যে আনা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। তিনি বলেন, হারবাল ও হোমিও চিকিৎসার আড়ালে যেসব প্রতিষ্ঠান যৌন চিকিৎসার ফাঁদ পেতে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তাদের ওপর কড়া নজরদারি বা মনিটরিং থাকা দরকার।
মাথায় চুল গজাতে গিয়ে বা ফর্সা হতে গিয়ে অনেকেই ত্বক ক্যান্সারের মুখোমুখিও হতে পারেন আশঙ্কা করে বাংলাদেশ মেডিক্যালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সিরাজুল হক বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমন কোনো মেডিসিন নেই। এসবই প্রতারণার জন্য প্রচারণা।’ জাতীয় হƒদরোগ ইনস্টিটিউটের মেডিসিন ও হƒদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রহমাতুল বারী জানান, ‘এসব চিকিৎসা আদৌ কতটুকু চিকিৎসার পর্যায়ে পড়ে তা বিবেচ্য সবার আগে। কেননা কাউকে ডায়াগনসিস না করে মুখে শুনে চিকিৎসা করা চিকিৎসা বিজ্ঞানবহিভর্‚ত আচরণ। তাছাড়া যে কোনো ওষুধেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে। হারবাল বলছে কীভাবে নিশ্চিত হবে রোগী এটা হারবাল উপাদানে তৈরি। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রোগী যে কোনো সমস্যা থেকে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. গোলাম কিবরিয়া জানান, চিকন বা মোটা হওয়ার সব রকমের চিকিৎসাও মেলে এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে। তবে তাৎক্ষণিক এসব চিকিৎসার ওষুধ সেবনে ফল পেলেও পরবর্তী সময়ে কিডনির ক্ষতি করে বলে মনে করেন তিনি। এসব চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি বলেন, ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা যদি হারবাল ওষুধ দিয়ে সমাধান হতো, তাহলে মানুষ বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিত না।
হোমিও চিকিৎসা, ইউনানি ও আয়ুর্বেদির নামে প্রতারণা
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে কালো তালিকাভুক্ত অর্ধশত ইউনানি ও আয়ুর্বেদি প্রতিষ্ঠান জনসাধারণের সঙ্গে একের পর এক প্রতারণা করে যাচ্ছে। সব জটিল রোগের ওষুধ উৎপাদনকারী এসব প্রতিষ্ঠান রাজধানীসহ সারাদেশে ইউনানি ও আয়ুর্বেদি ওষুধের নামে বছরের পর বছর রমরমা বাণিজ্য করছে। ১৯৮২ সালের ওষুধ অধ্যাদেশের ১৪ ধারা অনুসারে যে কোনো ধরনের ওষুধ বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন প্রচার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও ওষুধ প্রশাসনকে কোনো তোয়াক্কা না করে কালো তালিকাভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠান অনেক আগ থেকে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে ২৬১টি ইউনানি ও ১৬১টি আয়ুর্বেদি কোম্পানি রয়েছে। এগুলোর রেজিস্ট্রেশন থাকলেও এর বাইরে আরো প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
রেজিস্টার্ড কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২০টির ওষুধ গুণগত মানের। বাকিগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থের বিনিময়ে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের মন আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। আকর্ষণীয় এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ¯^ল্প শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষ প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছে।
ইউনানি ও আয়ুর্বেদির পাশাপাশি হোমিও চিকিৎসার নামেও চলছে জমজমাট প্রতারণা। রাজধানীজুড়ে গড়ে উঠেছে এই প্রতারকদের নেটওয়ার্ক। এর সদস্যরা ছোট ছোট কার্ড, লিফলেট বিতরণ করে মানুষ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান অবাধে গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের লিফলেট, পোস্টার ও বিজ্ঞাপনের ভাষা অভিন্ন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লিফলেটে ‘কম্পিউটারাইজড হোমিও সেন্টার’ নামে চিকিৎসা করে থাকে বলে উল্লেখ করে। এছাড়া প্রয়োজনে মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয় বলেও বিভ্রান্তিকর প্রচার চালায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতারিত লোকদের রোষানলে পড়ার আগেই রাতারাতি নাম-ঠিকানা পাল্টে ভিন্ন নামে ব্যবসা শুরু করে। মডার্ন ভেষজ কমপ্লেক্স, প্যারিস হারবাল গার্ডেন, জনতা দাওয়াখানা, পপুলার হারবাল মেডিক্যাল হোম, এশিয়া হারবাল মেডিক্যাল, বাংলাদেশ হারবাল মেডিক্যাল, আধুনিক হারবাল, দি হারবাল মেডিসিন সেন্টার, আমেরিকান হারবাল কমপ্লেক্স, আয়ুর্বেদ চিকিৎসা সেবা, এবি কোং, আল রাজী ভেষজ লাইফ, ডক্টরস ভেষজ চেম্বার, হারবাল পয়েন্ট, ইউএ হারবাল সেন্টার, আয়ুর্বেদ ভবন-ঢাকা, গ্রামীণ হারবাল মেডিক্যাল, ইন্ডিয়ান হারবাল মেডিক্যাল, হোমিও থেরাপি অ্যান্ড হেলথ কেয়ার, মডার্ন হোমিও রিসার্চ কমপ্লেক্স, ইন্টারন্যাশনাল হোমিও রিসার্চ, জার্মান হোমিও হেলথ, আমেরিকান হোমিও ক্লিনিক, মাদ্রাজ হারবাল মেডিক্যাল, ন্যাশনাল হারবাল, কলিকাতা হারবাল কেয়ার, আমেরিকা হারবাল মেডিক্যাল, ভিআইপি হারবাল মেডিক্যাল, হেকিমী দাওয়াখানা, ভেষজ হেলথ কমপ্লেক্স, ঢাকা হোমিও ক্লিনিক, দিল্লি হারবাল সেন্টার, ইউনানি হেলথ সেন্টার, পিওর হারবাল সেন্টারসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবাধে প্রতারণামূলক এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। পুরুষত্ব ও নারীর দেহসৌষ্ঠবের আকর্ষণ বৃদ্ধির নামে এরা বিক্রি করে নানা মানহীন, ভেজাল, অকার্যকর ওষুধ।
হারবাল ও হোমিওপ্যাথের লেবেল এঁটে বেশ চাকচিক্যময় মোড়কে তারা এসব পণ্য বিক্রি করছে নির্বিঘেœ। এসব পণ্যের মূল্য ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাতের শক্তি চায়না সেক্স মদক, সেক্স কিং জিনসেং মালিশ, স্পেশাল পিএইচ পাওয়ার অয়েল, এইচএম ৬০ এনার্জি ক্যাপসুল, এইচএম এইচ পাওয়ার অয়েল, নিশি মালতি জেনিট, স্পেশাল এএইচ পাওয়ার অয়েল, বিএইচ পাওয়ার অয়েল, স্পেশাল এইচএম পাওয়ার মালিশ, মদক, সেক্স পাওয়ার মদক, ব্রেস্টআপ লোশন, হর্স পাওয়ার লোশন, টাইগার ক্যাপসুল, সেক্স আম্বর ক্যাপসুল, সেক্স পাওয়ার জেলি, পাওয়ার গোপন লোশন, এইচপি কাপ, এইচপি মদক, খারাতিম লোশন, সেক্স পাওয়ার মালিশ, সেক্স পাওয়ার ক্যাপসুল, সেক্স পাওয়ার মদক, পুরুষত্বের প্রতীক মণিরাজ তেল, নারীর সৌন্দর্যের প্রতীক ডিএইচ ক্রিম, ইউএ মালিশ, ইউএ হারবাল ডাস্ট, ইউএ কুস্তায়ে হালুয়া, ইউএ কাপ, সেক্স পাওয়ার মদক, হর্স পাওয়ার লোশন, টাইগার ক্যাপসুল, নাইট কিং অয়েল, হারবাল জেনিটাল ডিউরেক্স স্পেশাল অয়েলসহ বিভিন্ন পণ্যের প্রচারের মাধ্যমে পুরুষ-নারীকে আকৃষ্ট করতে চায় প্রতিষ্ঠানগুলো। ঢাকার ৯৩ নিউ সার্কুলার রোডের লিলি প্লাজায় অবস্থিত হোমিও থেরাপি অ্যান্ড হেলথ কেয়ারের ডা. ওয়াজেদ আলীকে তার লিফলেটে উল্লিখিত পুরুষের বিশেষ অঙ্গ স্ফীত করার বিশেষ পণ্যের ব্যাপারে জানতে চেয়ে ফোন করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তাদের ওষুধ কতটা স্বাস্থ্যসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত জানতে চাইলে তাও জানাতে পারেননি তিনি। এ বিষয়ে সন্দেহের কথা তুললে তিনি ‘সন্দেহ থাকলে সন্দেহ নিয়ে বসে থাকেন’ বলে ফোন রেখে দেন। পরে তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। এর আগে তার প্রতিষ্ঠানের টিঅ্যান্ডটি ফোনে পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে অপরপ্রান্ত থেকে ‘তিনি (ডাক্তার) দেশে নেই’ বলে জানানো হয়। মহাখালী আমতলী মোড়ের এইচ-২৩ এয়ারপোর্ট রোড তৃতীয়তলায় অবস্থিত জার্মান হোমিও হেলথের চিকিৎসক ডা. এম এন ইসলামের মোবাইলে ফোন দেয়া হলে কথা বলেন ডা. বীরেন্দ্রনাথ সিকদার নামে এক ব্যক্তি।
তার কাছে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত পুরুষের বিশেষ অঙ্গের দুর্বলতা দূর করার স্পেশাল জেনিটাল ও মহিলাদের বিশেষ অঙ্গ বড় করার ক্রিম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের কাছে এ ধরনের কোনো পণ্য নেই। যৌন চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতকৃত তাদের ওষুধ কতটা মানসম্পন্ন এবং এ ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন কি না জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কথিত ডা. বীরেন্দ্রনাথ সিকদার।
এসব ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীর উদ্দীন আহমদ জানান, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকারের কঠোর হওয়া জরুরি। এসব অপকর্ম রোধে ড্রাগ প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাবকে অগ্রণী ভ‚মিকা নেয়ার আহŸান জানান তিনি। তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের ওষুধ নামধারী পণ্যগুলো খেয়ে বা ব্যবহার করে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেউ কেউ মারাও যাচ্ছে। বাসে, ট্রেনে বা জনসমাগমে যারা এ ধরনের ওষুধ বিক্রি বা লিফলেট বিতরণ করে তাদের ধরে শাস্তি দেয়া উচিত। এ ধরনের প্রতারণা থেকে জনগণকে রক্ষায় সরকারের উচিত ধারাবাহিকভাবে মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করা।
রূপচর্চায় হারবাল প্রতারণা
ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েরা রূপচর্চায় খুব বেশি মনোযোগী। সেই সুবাধে রূপচর্চার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যের প্রতি একটু দুর্বলতাও বেশি। তাই বাহারি বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে মান যাচাই না করে যুবক-যুবতীরা ব্যবহার করছে এ ধরনের পণ্য। বর্তমানে আমাদের দেশে রূপচর্চার পণ্য উৎপাদনে বেশ কিছু ভালো কোম্পানি এগিয়ে এসেছে। পাশাপাশি নামসর্বস্ব কিছু কোম্পানিও এ পণ্য উৎপাদন করছে। রূপচর্চায় হারবাল পণ্যের প্রতি সাধারণ মানুষের কদর থাকায় অনেকে তাদের কোম্পানির নামের শেষে হারবালজুড়ে দেয়। আবার এদের অনেকেই বিদেশি লেভেন নকল করছে।
জানা যায়, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগেও বেশ কিছু রূপচর্চার হারবাল পণ্য তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানা যায়, বেশ নিম্নমানের হারবাল কোম্পানিগুলোর একটি পণ্য তৈরিতে সর্বোচ্চ ১৮-২০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু এর গায়ে বিক্রয় মূল্য থাকে সর্বনিম্ন ৮০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা। এ কোম্পানিগুলো চকবাজারের কিছু পাইকারি দোকানকে ম্যানেজ করে ঢাকার কিছু এলাকা এবং গ্রামগঞ্জের দোকানগুলোতে ওইসব নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। দাম কম হওয়ায় পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের এসব পণ্যের প্রতি চাহিদাও একটু বেশি। অন্যদিকে মানহীন এসব পণ্য ক্রয় করে ত্বকের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেই থাকছেন সাধারণ মানুষ। এসব রূপচর্চার বিভিন্ন পণ্যে ব্যবহৃত হয় স্টিয়ারিক, প্যারাবেন, মিথাইল, জিঙ্ক, চর্বি ও সাইট্রিক এসিড।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেলের চর্ম বিভাগের ডা. মো. শাহজাহান জানান, সাইট্রিক এসিড, চর্বি ও জিংক থাকার ফলে ত্বক খুব অল্পদিনে সুন্দর হয়। কিন্তু হঠাৎ করে এ পণ্য ব্যবহার বন্ধ করে দিলে ব্যবহারকারীকে অধিক বয়স্ক দেখা যায় এবং ত্বকে স্থায়ী কালো দাগসহ অন্যান্য চর্ম রোগ জন্ম নেয়।
খোদা! এই ধরনের ভণ্ডামি থেকে এই সাধারণ মানুষদের তুমি হেফাজত কর।
——————————————————————————————–
পোষ্টের লিখুনির ব্যাপারে মন্তব্য করার স্পর্দা দেখাতে পারলামনা, শুধু এতটুকু বলবো; অসাধারণ!!! 🙂