পরবাসীদের দেশপ্রেম : পরানের গহীন ভেতরে একজন নিরন্তর কাঁদে
অগাষ্ট 11, 2011 এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান
ফজল হাসান
কোনো এক মনীষী বলেছেন, ‘দেশে জš§ালেই দেশ আপন হয় না। দেশকে জানতে হয় এবং ভালোবাসতে হয়।’ দেশকে জানার এই আগ্রহ এবং ভালোবাসার আকুতি হয়তো পরবাসী হলেই পরানের গহীন ভেতরে প্রকট হয়। কেননা পরবাসে থিতু হয়ে আসার আগেই বাংলাদেশিরা প্রথমে যে রোগে আক্রান্ত হন, তা হল ‘হোম সিকনেস’। এই হোম সিকনেসের কষ্টটা গির্জার ঘণ্টাধ্বনির মতো পরবাসী বাংলাদেশিদের বুকের ভেতর অহরহ বাজে। তখন থেকেই অস্থিমজ্জায় টের পাওয়া যায় দেশপ্রেম কাকে বলে। প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত রোগীর শরীরে তাপমাত্রা মাপার সময় থার্মোমিটারের পারদ হু হু করে বাড়ার মতো পরবাসীদের মনের ভেতর স্বদেশের প্রতি অনুভূতি এবং আকুতি বাড়তে থাকে। প্রবাদ আছে, ‘বৃক্ষ যত বিশাল হোক না কেন, ঝরা পাতা কিন্তু মাটিতেই ফিরে আসে।’ তবে মনের গহীন বনের ভেতর প্রচণ্ড ইচ্ছে-পাখি ডানা ঝাপটালেও পরবাসী অনেকেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য দেশে ফিরে যেতে পারেন না। তখন তারা প্রখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ার মতো ‘মন স্বদেশে, দেহ বিদেশে, অদ্ভুত এই টানাপোড়েন, মন মানে না, হƒদয় কাঁদে, খড়কুটো তাই আঁকড়ে ধরেন’।
দেশে ফিরে না যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে বিদেশের মাটিতে দীর্ঘ সময় বসবাস করার ফলে তাদের নিজস্ব ভুবনে দৃঢ়ভাবে প্রথিত হয় শেকড়-বাকড়। দিনে দিনে গাছপালার মতো বিস্তার লাভ করে সাজানো-গুছানো সংসার। ছেলেমেয়েদের সুন্দর এবং নিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা সেই ইচ্ছে-পাখিকে বুকের খাঁচায় শেকল পরিয়ে বেঁধে রাখেন। তখন তারা বিকল্প হিসেবে খোঁজেন অন্য মাধ্যম। কেউ কেউ দেশীয় রাজনীতির শাখা-প্রশাখা খুলে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন, অন্যরা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ছাতার নিচে থেকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবস উদযাপন, এমনকি রবীন্দ্র-নজরুল জš§ ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেন। এসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা খুঁজে বেড়ান স্বদেশের সোঁদা মাটির গন্ধ, ভুলে থাকতে চান দহন-জ্বালা।
মনের গভীরে মাতৃভূমির প্রতি পিছুটান, দেশের কাছে এক ধরনের দায়বদ্ধতা কিংবা আবেগের বোধ অবাধ্য বলেই হয়তো বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরের পরবাসী অনেক বাংলাদেশি দেশের দরিদ্র মানুরে জীবন সুন্দর করার জন্য আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন, এমনকি দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা কাতর হন, চোখেমুখে ফুটিয়ে তোলেন দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। তখন পরবাসে এই হরিণ-ছোটা ব্যস্ততা আর শত কাজের মাঝেও অনেকে সময়ের সঙ্গে সময় মাপতে মাপতে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা কোনো সংগঠনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুস্থ এবং পীড়িত মানুষকে আর্থিক সাহায্য করে থাকেন।
দুই.
সম্প্রতি জার্মান ত্রাণ সংগঠন, জাতিসংঘ ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড রিক্স রিপোর্ট’-এ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশকে। একাধিক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে বন উজাড় ও বনভূমি সঙ্কোচন।
অথচ বেঁচে থাকা, অর্থাৎ দেহ ও পুষ্টির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সবকিছুই আমরা পরিবেশ এবং গাছপালা থেকে সংগ্রহ করে থাকি। এছাড়া আমরা নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যে অক্সিজেন গ্রহণ করি, তাও গাছাপালা থেকে নির্গত হয়। প্রাণের সজীবতায় বৃক্ষের অবদান অসীম। স্বীকার করি বা না করি, গাছপালার কাছে প্রতিমুহূর্তে আমাদের ঋণ জমা হচ্ছে।
কয়েক সপ্তাহ আগে ‘বনাঞ্চল : প্রকৃতি আপনার সেবায়’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে অনুষ্ঠিত হল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ উপলক্ষে পরবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক’, সংক্ষেপে বিইএন বা বেন-এর অস্ট্রেলিয়া শাখা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে ছিল মুক্ত আলোচনা সভা, সিম্পোজিয়াম এবং বেশ কিছু মূল্যবান নিবন্ধন নিয়ে প্রকাশিত স্যুভেনির। এ ছাড়া এই সংগঠন দেশের বনভূমি রক্ষা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। বেনের মূল উদ্দেশ্য হল ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে পরবাসী বাংলাদেশি এবং বিদেশিদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা।
এবছর ক্যানবেরায় বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া অ্যাসোসিয়েশন বার্ষিক নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরের বিজ্ঞাপন বাবদ অর্জিত এবং স্পন্সরশিপ থেকে উপার্জিত অর্থের পুরোটাই ‘ওয়াক্ ফর লাইফ’ চ্যারিটি সংস্থাকে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার এই চ্যারিটি সংস্থা বাংলাদেশের বিকৃত পায়ের (ক্লাবফুট) রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার শিশু বিকৃত পা নিয়ে জš§গ্রহণ করে। এবারের মতো গত বছরও অ্যাসোসিয়েশন বার্ষিক নৈশভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরের বিজ্ঞাপন বাবদ অর্জিত এবং স্পন্সরশিপ থেকে উপার্জিত অর্থের পুরোটাই ‘অজি বাংলা স্মাইল’ চ্যারিটি সংস্থাকে প্রদান করেছে। উল্লেখ্য, ‘অজি বাংলা স্মাইল’ রোটারি ক্লাবের একটি প্রজেক্ট, যা বাংলাদেশের বিকৃত মুখের (ক্লেফট) রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করে।
তিন.
এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, পরবাসী বাংলাদেশিদের দেশপ্রেম নিখাদ। এতে কোনো স্বার্থ নেই, নেই কোনো চাওয়া-পাওয়ার জটিল হিসেব-নিকেশ। পরবাসী বাংলাদেশিরা দেশ এবং দেশবাসীর কল্যাণের জন্য যেটুকু সাহায্য ও সহযোগিতা করেন, তা তারা হোম সিকনেস কিংবা দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার টানেই করেন। কেননা প্রত্যেক পরবাসী বাংলাদেশির পরানের গহীন ভেতরে একজন নিরন্তর কাঁদে। সূত্রঃ http://www.banglamati.net/august-11/nibondho-2.php
এই লেখা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য বা সুচিন্তিত অভিমত লিখে আমাদের কাছে মেইল করুন। বাংলামাটির পরবর্তী সংখ্যায় তা প্রকাশ করা হবে।
banglamati@gmail.com